গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
‘তোমরা ভালো কাজের আদেশ কর, মন্দ কাজে নিষেধ কর’- এই হচ্ছে কোরআনে পাকের একটি সর্বজন পরিচিত আয়াতাংশ। এই আয়াতাংশের দুটি কথাই হলো সুখী সমাজ গঠনের মূল প্রাণশক্তি।
যে কোনো কাজ তা হয় ভালো নয়তো মন্দ, হয় কল্যাণকর না হয় ক্ষতিকর। অর্থাৎ প্রত্যেক কাজেরই দুটি দিক আছে- ভালো কিংবা মন্দ। পৃথিবীতে এমন কোনো লোক পাওয়া যাবে না যে ভালোর পরিবর্তে খারাপ কাজকে পছন্দ করবে। যদি কেউ খারাপ কাজকে পছন্দ করেই থাকে, তবে সে ভালো মনে করেই করে। যেহেতু কেউ খারাপ চায় না, খারাপ পছন্দ করে না, সেহেতু সারা দুনিয়া তো ‘স্বর্গরাজ্য’ই হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু আমরা কী দেখছি? পুরো বিপরীত চিত্র। কিন্তু কেন?
উপরোক্ত আয়াতের দুটি অংশ রয়েছে, ‘ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ।’ কেউ যদি কাউকে ভালো কাজের আদেশ নয়, অন্তত পরামর্শ দিতেও হয় তবে তাকে আগে ভালো কাজ করতে হয়, নচেৎ তার পরামর্শ কার্যকর বা ফলপ্রসূ হয় না, মানুষ তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হয় না। কিন্তু যখন কেউ আরেকজনকে ভালো কাজের আদেশ করবে, তখন তা নিখুঁতভাবে ভালো হতে হবে বা ভালো কাজ করতে হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর তার নিজের ভালো কাজের মধ্যে যদি সামান্যতম ঘাটতি থাকে, তবে তার ভালো কাজের বুলি উপেক্ষিত হতে বাধ্য। এদের সবার উদ্দেশে কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেরা যা কর না, তা অন্যদের করতে বলো কেন?’ আয়াতাংশের দ্বিতীয়াংশ হলো, মন্দ কাজে নিষেধ করা। এই কাজটি প্রথমটি থেকে অনেক কঠিন। কেননা একজন লোককে ভালো কাজের আদেশ করা যত সহজ, মন্দ কাজে নিষেধ করা তত সহজ নয়। এটা করতে গেলে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
একজন মুমিনের ঈমানের ওপর অত্যাবশ্যক কর্ম হলো নামাজ আদায় করা। হাদিসে এসেছে, মুমিন ও কাফিরের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে নামাজ ছেড়ে দেওয়া। মানে নামাজ তরককারীর প্রতি রয়েছে কঠোর হুশিয়ারি, যা অন্য কোনো ব্যাপারে বলা হয়েছে কি-না সন্দেহ। নামাজ সংক্রান্ত ব্যাপারে এত বেশি কঠোরতা প্রদর্শন করার কারণ হলো, এটাই ঈমানের পরিচায়ক। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি জিন এবং ইনসানকে কেবলই আমার এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ আর এবাদতের সর্বোত্তম প্রকাশ হচ্ছে নামাজ।
একজন মানুষ যখন নিয়মিত নামাজ আদায় করবে, তখন তার পক্ষে সম্ভব নয় সুদ-ঘুষ খাওয়া। ঠিক একইভাবে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া। ইসলামের সর্বশেষ স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত। এটা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ঘোষণা করেন, ‘খোদার কসম, যারা রসুল (সা.)-এর সময় জাকাত প্রদান করতো, তারা যদি আজ উটের একটি রশি দিতেও অস্বীকার করে, তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করব। অর্থাৎ জাকাতের প্রতি যেন সামান্যতমও অবহেলা করা না হয়। যদি আমরা যথাযথ হিসাবে জাকাত প্রদান করতাম, তাহলে দরিদ্রতা থাকত না। আর যে ব্যক্তির মধ্যে জাকাত প্রদান করার মতো মনোবৃত্তি সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে মানুষের প্রতি দয়ামায়া ও ভালোবাসা জাগ্রত হয়। সত্যিকারভাবে যারা জাকাত প্রদান করবে, তারা কখনো অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারে না। সবাই যখন অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন থেকে হাত গুটাবে, তখন দেশ স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।
ইসলামের বিধি-বিধানের সামান্যতমও যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রের পুরো কাঠামোই বদলে যাবে। বর্তমান সমাজ কাঠামোর যেদিকে আমরা নজর দিই, হতাশা আমাদের গ্রাস করবেই। মন্ত্রণালয় থেকে একেবারে নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত যে দিকেই প্রত্যক্ষ করা যায়, দেখা যাবে সর্বত্রই যেন দুর্নীতির জাল বিস্তৃত। আপনি যেখানেই যান না কেন, স্বস্তি পাবেন না। মনে হয় মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ই চলে গেছে আমাদের স্বস্তি ও নিরাপত্তা। হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য কত মনীষী কত আশার বাণী শোনাচ্ছেন কিন্তু তাদের আশার কোমল বাণী যেন উষ্ণ হতাশায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা ভাবছেন, বর্তমান সমাজের অবক্ষয় থেকে কী করে মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু তাদের গবেষণালব্ধ হাজার হাজার পৃষ্ঠার গবেষণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে অবক্ষয় বাড়তেই থাকছে। মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সমন্বিত প্রয়াসের রেজাল্ট অবশেষে শূন্য প্রমাণিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তাদের গবেষণায় কোথায় যেন এক বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে।
এ ছাড়া যদি আমরা অন্তত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি এবং বিবেককে প্রশ্ন করি, আমরা কি সঠিক কাজ করছি, নাকি ভ্রান্ত মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছি- ঠিক তখনই আমাদের মধ্যে জাগ্রত হবে দুর্নীতিমুক্ত, সুস্থ-সুন্দর ও আলোকিত সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাণশক্তি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট